কৃষি, রসায়ন শিল্প, টয়লেট্রিজ এবং ঔষধ সেবনে pH ও বাফার সিস্টেম এর গুরুত্ব।
আমাদের জীবন চক্রে pH একটি অপরিহার্য অনুসঙ্গ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবন প্রবাহের প্রতিটি প্রক্রিয়ায় এবং আনুস্বঙ্গিকতায় pH এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। তারই কয়েকটি নিচে আলোচনা করা হলো।
কৃষিতে pH এর গুরুত্ব
কৃষি উৎপাদন নির্ভর করে উদ্ভিদের খাদ্য গ্রহণ, পুষ্টি ও বৃদ্ধির উপর। আর তা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত হয় মাটির উর্বরতা দ্বারা। মাটির উর্বরতা এর pH মান দ্বারা প্রভাবিত হয়। মাটির pH এতই গুরুত্বপূর্ণ যে বলা হয়ে থাকে যে মাটির pH 3 এর চেয়ে কম এবং 10 এর চেয়ে বেশি অর্থাৎ অত্যধিক অম্লীয় ও ক্ষারীয় পরিবেশ সে মাটি অনুজীব মুক্ত থাকে। ফলে কোন ফসল উৎপাদন হয় না। এজন্য এসিড-বৃষ্টি হলে pH হ্রাস বলে এবং কোন জমিতে পর পর একাধিক ফসল উৎপাদন করার ফলে pH নিয়ন্ত্রণকারী উপাদান অপসারিত হওয়ায় সেসব জমিতে ফসল উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। সর্বোচ্চ কৃষি উৎপাদনের অনুকূল pH হলো 7.0–8.0। এ কারণে কৃষির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য pH মান নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট বাফার সিস্টেম প্রয়োগ অপরিহার্য।
উদ্ভিদের পরিবর্ধনের সময় শিকড়ের সাহায্যে Ca, Mg এবং অন্যান্য ক্ষার উৎপাদনকারী মৌল দ্রবণীয় যৌগ হিসেবে মাটি থেকে গৃহীত হয়। এতে মাটির pH মান হ্রাস পায়। তখন চুন, ডলোমাইট (CaCO3.MgCO3) বা Ca / Mg ধারী বিভিন্ন সার ব্যবহার করে মাটির এসিডীয় প্রকৃতি প্রশমিত করা হয়। এতে pH মান বৃদ্ধি পায় এবং ঐ মাটিতে গম, ভুট্টা, চীনা বাদাম প্রভৃতির ফলন সম্ভব হয়। আবার অনেক সময় কোন ফল যদি টক হয় যেমন আঙ্গুর, তবে ঐ গাছের গোড়ায় মাটিতে চুন প্রয়োগ করলে টক অর্থাৎ অম্লতা প্রশমিত হয়ে পরবর্তী ফলনে ঐ একই গাছের ফল মিষ্টি হতে দেখা যায়।
আবার মাটির pH মাত্রারিক্ত বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন অম্ল উৎপাদনকারী পদার্থ যেমন নাইট্রেট সার (KNO3, NaNO3, NH4NO3) এবং ফসফেট সার [সুপার ফসফেট (SP) ও ট্রিপল সুপার ফসফেট (TSP)] প্রয়োগ করে মাটির I pH নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আর এভাবে খাদ্য শস্যের উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হয়।
রসায়ন শিল্পে pH এর গুরুত্ব
রসায়ন শিল্প উৎপাদন প্রক্রিয়ায় pH এর ভূমিকা প্রায় একচ্ছত্র। উৎপাদন মাত্রা, উৎপাদন হার এবং উৎপন্ন দ্রব্যের গুণাগুণ এ সবকিছুর উপরই pH এর প্রভাব রয়েছে। কারণ প্রতিটি রাসায়নিক শিল্প পণ্য উৎপাদনে কোন না কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া সংশ্লিষ্ট থাকে। আর প্রতিটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার অন্যতম নিয়ামক হলো pH।
বিভিন্ন ঔষধ এবং চিকিৎসাসামগ্রী (যেমন স্যালাইন, হরমোন, এনজাইম ইত্যাদি) উৎপাদনে pH নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। এছাড়া ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ায় (যেমন ইথানল, ইথানয়িক এসিড উৎপাদন) অণুজীবের কার্যকারিতার জন্য নির্দিষ্ট pH সংরক্ষণ করতে হয়। চিনি কলে আখের রস থেকে চিনি উৎপাদনের সময় চিনির ইনভারশান রোধে নির্দিষ্ট pH নিয়ন্ত্রণ জরুরি। নতুবা চিনি (সুক্রোজ) আর্দ্রবিশ্লেষিত হয়ে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ এর সমমোলার মিশ্রণ তথা ইনভার্ট সুগার-এ পরিণত হয়। অর্থাৎ চিনি উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
এছাড়া চামড়া ট্যানিং, ফ্যাব্রিক উৎপাদন, কাপড় ডাইয়িং, কাপড়ে বিভিন্ন রঞ্জক দ্বারা ব্লক প্রিন্ট করা, কাগজ উৎপাদনে মণ্ডের (Pulp) প্রক্রিয়াকরণ, বায়োলোজিকাল কালচার উৎপাদন প্রভৃতি প্রতিটি শিল্প উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট pH মান বজায় রাখতে হয়। এমনকি কলমের কালি উৎপাদন, তেলফেনা ভাসমান প্রক্রিয়ায় সালফাইড আকরিক গাঢ়ীকরণ, বেকারিতে বিস্কুট-কেক তৈরি, লজেন্স-চকোলেট উৎপাদন এবং শিল্প বর্জ্য পরিশোধনে ETP তে pH নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।
টয়লেট্রিজ-এ pH এর গুরুত্ব
আমাদের শরীরে বহিরাবরণ যেমন ত্বক, চুল প্রভৃতি পরিচর্যার জন্য ব্যবহৃত সামগ্রীর নামই টয়লেট্রিজ বা প্রসাধন সামগ্রী যেমন সাবান, শ্যাম্পু, ফেস ওয়াশ, ক্রীম, লোশান, জেল ইত্যাদি। ত্বকের বহিরাবরণ corneal layer কেরাটিন ও কোলাজেন নামক তন্ত্রময় প্রোটিন দ্বারা গঠিত। এ layer টি প্রাকৃতিক ভাবে 10% আর্দ্রতা থাকে। আর্দ্রতা যখন 10% এর নিচে নেমে যায় তখন corneal layersএর নিয়ে অবস্থিত sebaceous gland থেকে sebum নামক তৈলাক্ত নিঃসরণ ঘটে ত্বকের হারানো আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনে এবং ত্বক আবার সতেজ হয়। এ viscous fluidটি একটি antioxidant এবং acidic যা ত্বকের pH মান 4.0 – 5.5 তে বজায় রাখে। এরপরও সূর্যের তাপে ও বায়ুতে ত্বক শুষ্ক ও খসখসে হলে একে moisturize করে pH মান 4 – 5.5 এ অক্ষুণ্ণ রাখতে বিভিন্ন ক্রিম, লোশান প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়।
প্রসাধনীসমূহের pH মান 5.5 এর বেশি হলে ত্বকের এসিড আবরণটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ত্বকের সজীবতা নষ্ট হয়। ত্বকের এসিড আবরণ রক্ষার জন্য antioxidant সমূহ (ভিটামিন A, C, E) কার্যকর ভূমিকা রাখে। ত্বককে ব্যাকটেরিয়ার প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে হলে এর pH মান 4.0–5.5 এ বজায় রাখতে হয়। তাই ত্বক পরিচর্যার ক্রিম ও লোশনে মৃদু এসিডীয় উপাদান (pH 4.0–5.5) ব্যবহার করা হয় যা ত্বককে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা করে এবং moisturize করে। বস্তুত এ কারণেই ত্বকও চুলের জন্য ব্যবহার্য সকল বাণিজ্যিক ডিটারজেন্ট, শ্যাম্পু, ক্রিম ও লোশানে pH 4.0 5.5 বজায় রাখা হয়। এছাড়া ত্বকের নরম অনুভূতি রক্ষার জন্য এসব প্রসাধনীতে বিভিন্ন রকম emollients যেমন পেট্রোলিয়াম জেলি ও ভ্যাসেলিন ব্যবহার করা হয়।
ঔষধ সেবনে pH এর গুরুত্ব
আমাদের শরীর একটি বিশাল ও অতি জটিল রাসায়নিক কারখানা। সেহতন্ত্রকে সঠিকভাবে চালু রাখার জন্য এর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের অংশগ্রহণে অসংখ্য প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়া অবিরাম ঘটে চলেছে। এসব প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়া কোন না কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সংঘটিত হচ্ছে। আর প্রত্যেকটি মেটাবোলিক পরিবর্তন এক একটি নির্দিষ্ট এনযাইম (কনযুগেটেড প্রোটিন) দ্বারা প্রভাবিত হয়।
আবার এনজাইমগুলোর প্রতিটি সংশ্লেষিত হচ্ছে নিজস্ব প্রক্রিয়ায় এ দেহতন্ত্রের ভেতরেই। শরীরের রাসায়নিক দ্রব্যের দুই তৃতীয়াংশই পানি। এতে রয়েছে অসংখ্য খনিজ দ্রব্য। রক্ত এবং বিভিন্ন শরীর তন্ত্রীয় ফ্লুইডে দ্রবীভূত আছে বিভিন্ন লবণ। হাড় এবং দাঁতের গঠনে রয়েছে ফসফেট শিলায় উপস্থিত খনিজ দ্রব্য হাইড্রক্সি অ্যাপাটাইট সদৃশ পদার্থ।
আবার রক্তে আছে সামান্য গ্লুকোজ। ত্বকের নিচে থাকে চর্বি। লিভার এবং মাংসপেশিতে দেখা যায় গ্লাইকোজেন নামক স্টার্চ। প্রতিটি কোষে রয়েছে প্রোটিন অর্থাৎ পলিপেপটাইড (পলি অ্যামাইড)। এসবের অংশগ্রহণে ঘটছে প্রাণ রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো যেমন হেম এবং গ্লোবিনের (প্রোটিন) সময়ে গঠিত হেমোগ্লোবিন নামক এনজাইম প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিঃশ্বাসের সঙ্গে গৃহীত অক্সিজেন কে ফুসফুস থেকে টিস্যুতে বহন করে। একইভাবে কাইমোট্রিপসিন (245টি অ্যামিনো এসিড অণু ও হেম দ্বারা গঠিত) নামক এনজাইম প্রেটিনের পেপটাইড বন্ধনকে আর্দ্র-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভেঙে অ্যামিনো এসিডে পরিণত করে ও আমাদের পরিপাক ক্রিয়া (digestion) ঘটায়।
রক্তের লোহিত কণিকায় রয়েছে কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ নামক একটি এনজাইম যা CO2 এবং H2O থেকে কার্বনিক এসিড তৈরির বিক্রিয়াকে 107 গুণ দ্রুত ঘটায় । কার্বনিক
অ্যানহাইড্রেজ স্ট্রেপটোকাইনেজ নামক গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর করোনারী ধমনীর জমাট বাঁধা রক্ত (block) দ্রবীভূত করে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে। এসব অসংখ্য প্রাণ-রাসায়নিক বিক্রিয়া যতক্ষণ স্বাভাবিক নির্বিঘ্ন প্রক্রিয়ায় ঘটতে পারে ততক্ষণ আমাদের শরীর ভালো থাকে। এনজাইম দ্বারা প্রভাবিত এসব প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়া সঠিকভাবে ঘটার জন্য প্রতিটি তন্ত্রে উপস্থিত ফ্লুইডের সুনির্দিষ্ট pH থাকতে হয়। যেমন
i) মুখের লালার (saliva) pH = 6.35 – 6.68
ii) চোখের পানির pH = 4.8 – 7.5
iii) মাতৃদুধের pH = 6.6– 6.9,
iv) প্রস্রাবে pH = 4.8 – 7.5
v) রক্তের pH = 7.4
vi) পাকস্থলীর রসের pH 1.4-2 পর্যন্ত থাকে।
আমাদের শরীর তন্ত্রের কোথাও এসব pH নিয়ন্ত্রিত কোন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটলে আমরা অসুস্থ বোধ করি। শরীরের যে অংশে ব্যাঘাত ঘটে সে অংশেই অসুখ হয়। যেমন আমরা বলে থাকি মাথা ব্যাথা, পেটের পীড়া, হজমের গোলমাল বা হৃদরোগ। আর এসব অসুখ নিরাময় করে শরীর তন্ত্রের প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন করতেই আমরা চিকিৎসকের পরামর্শে বিভিন্ন উপযোগী রাসায়নিক দ্রব্য ঔষধ রূপে গ্রহণ করি। এসব ঔষধ আন্তঃকোষে শোষিত হয়ে রক্ত প্রবাহে মিশে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট তন্ত্রের অসুস্থতা দূর করে।
ওষুধের শোষণ শরীরের প্রতিটি প্রবেশ পথের ত্বক দ্বারা ঘটে। ওষুধের এ শোষণ প্রক্রিয়া এর দ্রাব্যতা, দ্রবণে আয়নিকরণ বা বিয়োজন মাত্রা এবং pH মানের উপর নির্ভর করে। ঔষধের একাংশ বিয়োজিত / আয়নিত হয় এবং অপরাংশ অবিয়োজিত অণু রূপে থাকে। এর মধ্যে অবিয়োজিত ঔষধ অণুই অধিক কার্যকরভাবে শোষিত হয়। আর এ শোষণ প্রক্রিয়া তন্ত্রের pH মানের উপর নির্ভরশীল।
শরীরের যে তন্ত্রের pH মান এসিডীয় সেখানে অম্লধর্মী ঔষধের বিয়োজন ঘটে না বলে তা নির্বিঘ্নে শোষিত হয়। যেমন জ্বর ও ব্যথা নিবারক ঔষধ অ্যাসপিরিন (অক্সি অ্যাসিটিল স্যালিসাইলিক এসিড) এবং প্যারাসিটামল (N-অ্যাসিটো-4-অ্যামিনোফেনল) অম্লধর্মী বলে পাকস্থলীর অম্লীয় পরিবেশে (pH = 1.4–2) এর বিয়োজন ঘটে না। তাই এ ওষুধগুলোর শোষণ পাকস্থলীতে কার্যকরভাবে ঘটে।
আবার ম্যালেরিয়া জ্বরের ওষধ ক্লোরোকুইন সামান্য ক্ষারধর্মী। এজন্য ক্ষুদ্রান্ত্রের ক্ষারীয় পরিবেশে (7.5) এটি শোষিত হয়। একইভাবে পেনিসিলিন এবং এরিথ্রোমাইসিন প্রভৃতি অ্যান্টিবায়োটিক গ্যাস্ট্রিক pH -এ বিয়োজিত হয়, শোষিত হয় না। এর শোষণের সঠিক স্থান ক্ষারীয় pH -এ অর্থাৎ ক্ষুদ্রান্ত্রে। অনেক সময় ঔষধের শোষণ ত্বরান্বিত করার জন্য intravenus ইনজেকশনের মাধ্যমে সরাসরি শিরা দিয়ে রক্তে মিশিয়ে দেয়া হয়।