পরিবেশের উপর কীটনাশকের প্রভাব আলোচনা কর।

কীটনাশক মানুষ, প্রাণী, পাখি, গাছ, মাটি, জগত পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। নিচে পরিবেশের উপর কীটনাশকের প্রভাব আলোচনা করা হলো।

ক) মানুষের উপর কীটনাশকের প্রভাব

কীটনাশকসমূহের মধ্যে জৈব ক্লোরিন কীটনাশক মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। কীটনাশকের প্রভাবে মানুষের শরীরে নিম্নোক্ত ক্ষতি হয়-

  • মানুষের শরীর ও রক্ত যদি DDT শোষণ করে তবে এর ফলস্বরূপ মানুষের বমি বমি ভাব, হাত পা কাপা, খিচুনী প্রভৃতি দেখা যায়। এছাড়া রক্তে এদের মাত্রা বেড়ে গেলে ক্যান্সার হতে পারে।
  • অ্যালড্রিন, BHC, ক্লোরডেন ইত্যাদি শোষণের ফলে হার্ট, ব্রেইন, কিডনি, লিভার আক্রান্ত হয় যা খুবই মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে।
  • জৈব ক্লোরিন কীটনাশক উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের রক্ত-ক্যান্সার, মাথায় ক্যান্সার বা টিউমার, ফুসফুস ও পাকস্থলির ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
  • জৈব ফসফেটসমূহ যদিও পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী নয় কিন্তু এদের বিষাক্ততা এতটাই বেশি যে অল্প সময়ের মধ্যে এসব পদার্থ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। জৈব ফসফেট কীটনাশকের প্রভাবে চোখে ছানি পড়া, দৃষ্টিহীনতা, মাথা ধরা, বমি বমি ভাব, কেন্দ্রীয় ও বাহ্যিক স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, ডায়রিয়া প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
  • কীটনাশকের দীর্ঘস্থায়ী সঞ্চয়ে যকৃৎ ও কিডনির বিশৃঙ্খল কার্যক্রম মানুষের রক্তে ও মূত্রে অতিরিক্ত অ্যামিনো এসিড নিঃসরণ ও মস্তিষ্ক কলার রক্তের অস্বাভাবিকতা দেখা যায়।
  • খাদ্যের মধ্যে দীর্ঘদিন কীটনাশকের অবশেষ থাকলে তাৎক্ষণিক মারাত্মক বিষক্রিয়ার চেয়ে জাতীয় স্বাস্থ্যের দিকে অধিকতর মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
  • খাদ্য শৃঙ্খলে DDT সঞ্চিত হওয়া খুবই মারাত্মক। কারণ এটি বিভিন্ন জীবন্ত দেহে পুনঃচত্রায়ন হয়।
effect of pesticides on environment
কীটনাশক মাটি, পানি, বন্যপ্রানী এমনকি মানব দেহে হরমোনের উপরেও প্রভাব ফেলে।

(খ) প্রাণীর উপর কীটনাশকের প্রভাব

  • এলড্রিন, ডাইএলড্রিন, ক্লোরোডন, এন্ডোসালফেন, হেপ্টাক্লোর ও গ্যামস্ক্রিন এর মতো কীটনাশক বন্যপ্রাণীর শরীরের উপর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ফলে তাদের মেটাবলিক ক্রিয়া এবং দেহ রসায়ন পরিবর্তিত হয়।
  • অর্গানোফসফেট কীটনাশক প্রাণীর উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, এ ধরনের কীটনাশকের ক্রিয়ায় প্রাণীর শরীরের পেশি দুর্বল হয়, বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় না এবং প্রাণীর শারীরিক কম্পনের অনুভূতির সৃষ্টি করে।
  • কীটনাশক ছিটানো মাঠ ও দূষিত পানি ও ক্যানেল হতে পানি পান করে প্রাণী মারা যেতে পারে।
  • এলড্রিন, ডাইএলড্রিন, কার্বোফুরান ডাইমেক্রন ইত্যাদি কীটনাশক খাদ্য চক্রকে নষ্ট করে ফেলে।

(গ) পাখির উপর কীটনাশকের প্রভাব

  • কীটনাশক ব্যবহারে পাখিদের মধ্যে বিষক্রিয়া এবং প্রজননজনিত সমস্যার উদ্ভব ঘটে।
  • কীটনাশকের ফলে পাখিরা পাতলা খোসা যুক্ত ডিম দেয়। ফলে বেশিরভাগ ডিম নষ্ট হয়ে যায়। পাখিদের নবজাতকের বেঁচে থাকার হার অবনমিত হয়।
  • পাখিদের দেহে কীটনাশকের উপস্থিতির ফলে পাখিদের লিভারে এনজাইমের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। সক্রিয়বএনজাইম পাখির Sex হরমোনকে আক্রমণ করে। এর ফলে তিনটি ফলাফল দেখা যায়। প্রথমত, পাখিদের বাচ্চা প্রসব অনেক দেরিতে হয়। দ্বিতীয়ত, আগের ক্ষতিপূরণ করার জন্য নতুন করে পাখিরা ডিম পাড়ে না। এবং পূর্বেকার ক্ষতি স্থানে নতুন ডিম প্রতিস্থাপিত হয় না। তৃতীয়ত, সামান্য কতক ডিম পাড়ে। এসব ফ্যাক্টর পাখিদের বংশ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে অবনতি ঘটে।

(ঘ) মাটির উপর কীটনাশকের প্রভাব

কীটনাশক অন্যান্যদের ক্ষতিকরার মতো মাটির উপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এজন্য মাটির সকল গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায় এবং ফসল ফলানোর জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো নিম্নে দেওয়া হলো:

  • পুকুরের পানিতে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পুকুরের তলদেশের মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয় ফলে মাছ চাষের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
  • কীটনাশকের মধ্যে সর্বাধিক বিপদজনক অর্গানোক্লোরিন কীটনাশক মাটির মধ্যে দীর্ঘদিন স্থায়ী অবস্থায় থেকে খাদ্যশস্যের গুণাগুণ না করে।
  • কীটনাশক Soil practice এর সাথে যুক্ত থেকে উদ্ভিদের বৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে।
  • কীটনাশক মাটিতে আটকে থাকে যার ফলে উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে ব্যাহত হয়।
  • কীটনাশকের প্রভাবে মাটিতে বসবাসরত অণুজীবের সংখ্যা হ্রাস পায়। যে অণুজীব মাটির উর্বরত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

(ঙ) জলজ প্রাণীর উপর কীটনাশকের প্রভাব

  • পরীক্ষা করে দেখা গেছে ব্যবহৃত ডিডিটির 25%ই শেষমেষ সমুদ্রের পানিতে গিয়ে মিশে। অতিসামান্য পরিমাণ ডিডিটি বা অন্যান্য বিষাক্ত কীটনাশক জলজ প্রাণীদেহে জমা হলে তা তাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
  • কীটনাশকের প্রভাবে মাছে নিম্ন তাপমাত্রা সহ্য ক্ষমতা হ্রাস পায়।
  • DDT বা অন্যান্য কীটনাশক দ্বারা প্রথমে আক্রান্ত হয় প্ল্যাংকটন জাতীয় উদ্ভিদ এবং সেখান থেকে ছোট মাছ এবং পরে বড় মাছ আক্রান্ত হয়।
  • সামুদ্রিক প্রাণীর টিস্যুতে সহজেই কীটনাশক জমা হয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
  • মাছের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়।
  • কীটনাশকের প্রভাবে জলজ প্রাণীদের মধ্যে খাদ্য-শৃঙ্খল ভেঙে পড়ে।

দূষণ সংক্রান্ত অন্যান্য প্রশ্ন-

মানব স্বাস্থ্যের উপর মাটি দূষণের প্রভাব ব্যাখ্যা কর।

সিসা দূষণের ফলে মানব দেহে কি রোগ হয়?

মানব স্বাস্থ্যের উপর মাটি দূষণের প্রভাব ব্যাখ্যা কর।